স্বদেশ বার্তা ডেস্কঃ সারা দেশের চোখ এখন রংপুর সিটিতে। আগামীকাল কার ভাগ্যে জুটবে মেয়রের পদ এ আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। একদিকে এরশাদের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত রংপুরে আলোচনার শীর্ষে জাতীয় পার্টি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা বর্তমান মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু। থেমে নেই বিএনপিও। দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন রংপুরে। ভোটাররাও মুখ খুলছেন না। চলছে শেষ মুহূর্তের ভোটের হিসাব-নিকাশ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চমক আসতে পারে আগামীকালের ফলাফলে। এখন শুধুই অপেক্ষা। এদিকে ভোটযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত প্রার্থীরা। বছরের শেষ ভোট সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন ঘিরে কিছুটা উত্তেজনা থাকলেও সর্বত্র নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। থাকবে চার স্তরের নিরাপত্তা-বলয়। আজ রাত পোহালে কাল ভোট গ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা এ ভোট গ্রহণ চলবে। ভোটের দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে রংপুরে। বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় আজ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রংপুর জুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় উত্তাল ছিল এই উত্তরের জনপদ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়েছেন তিন হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু, জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও বিএনপির কাওসার জামান বাবলা। এরই মধ্যে সোমবার মধ্যরাত থেকে বহিরাগতরা রংপুর ছেড়েছেন। গতকাল মধ্যরাত থেকে সব ধরনের প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আজ মধ্যরাত থেকে আগামীকাল মধ্যরাত পর্যন্ত স্থলযান, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, ইজিবাইকসহ সব ধরনের যানবাহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এ ছাড়া সোমবার থেকেই মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নির্বাচনে প্রার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক, সাংবাদিকসহ নির্বাচনী এজেন্টদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। একইভাবে জাতীয় মহাসড়কেও এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। মহিলা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভোটারদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এবারই প্রথম রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে তিন দিনব্যাপী ওই কেন্দ্রের ভোটারদের অবহিত করতে ইভিএম পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি এবার নির্বাচনে তিনটি কেন্দ্রে থাকবে সিসি ক্যামেরাও। ইতিমধ্যে ওই কেন্দ্রগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। রংপুর সিটি করপোরেশনে ৩৩টি সাধারণ ও ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। মোট ভোটার তিন লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৪ জন।
এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯৬ হাজার ২৫৬ ও নারী ভোটার এক লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৯৩টি। ভোটকক্ষ এক হাজার ১৭৮টি। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা তিন হাজার ৫৫৯ জন। আগামীকালের ভোট নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আবদুর রউফ সরকার বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসবের পাশাপাশি উদ্বেগও বিরাজ করছে। তবে এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সবাই সবাইকে চেনেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি রয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা চাই রংপুর সিটি করপোরেশনে একজন ভালো মানুষ মেয়র নির্বাচিত হোক। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রংপুরে এখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে। তবে সামনে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
শেষ মুহূর্তের প্রচারণা : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু গতকাল সকাল ৮টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে জাহাজ কোম্পানির মোড় এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে স্টেশন রোড, শাপলা চত্বর, চব্বিশ হাজারীসহ কয়েকটি এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করে ভোট প্রার্থনা করেন তিনি। জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা গতকাল সকালে বেরিয়ে পড়েন ভোট চাইতে। নগরের কাচারীবাজার, গোমস্তাপাড়া, মুন্সিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন তিনি। বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা মাহীগঞ্জ, সাতমাথা, তাজহাট, রঘুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন। অন্যদিকে বাসদের মেয়র প্রার্থী আবদুল কুদ্দুস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এ টি এম গোলাম মোস্তফা বাবু, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সেলিম আখতার এবং একমাত্র স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। এদিকে মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি ৩৩টি ওয়ার্ডে পুরুষ ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও শেষবারের মতো গণসংযোগ করেছেন।
থকেছে বিশেষ নিরাপত্তা, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সদস্যরা বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশ-সংক্রান্ত কমিটির সদস্য পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের জানান, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। এদিকে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নিরাপত্তায় থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ হাজার ৫০০ সদস্য। এর মধ্যে বিজিবির ২১ প্লাটুন (৬৩০ জন), র্যাবের ৩৩টি টিম (৪০০ জন) এবং পুলিশ ও আনসার সদস্য থাকবেন চার হাজার ৪৭০ জন। এ ছাড়া একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ৩৩টি স্ট্রাইকিং ফোর্স, একজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। গতকাল থেকে নগরীতে বিজিবির সদস্যরা টহল শুরু করেছেন। মাঠে আছে ৩৩টি স্ট্রাইকিং ফোর্স। এদিকে নির্বাচনী মাঠে নামছে নির্বাচন কমিশনের ১১টি ‘নীরব পর্যবেক্ষক’ দল। ইসির নিজস্ব এসব কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রেখে নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুরের প্রবেশদ্বার, রংপুর শহর, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক চৌকি। পাড়া-মহল্লায় র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি টহল দিচ্ছে।
১৯৩ কেন্দ্রের মধ্যে ১০৮টিই ঝুঁকিপূর্ণ : রংপুর সিটি নির্বাচনে ১৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। রিটার্নিং ও রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হবে।
এক কেন্দ্রে ইভিএম : ১৯৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র একটিতে ইভিএম ব্যবহারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। এটি হলো নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪১ নম্বর কেন্দ্র সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ। এ কেন্দ্রের ছয়টি বুথে ইভিএমে ভোট দিতে পারবেন দুই হাজার ৫৯ জন ভোটার। গতকাল পর্যন্ত ভোটারদের ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তিন কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা : ১৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হলো ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ কেন্দ্র।
নির্বাচনসামগ্রী কেন্দ্রে যাবে আজ : রিটার্নিং ও রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আজ থেকে প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনসামগ্রী পাঠানো হবে।
সুজনের মানববন্ধন : অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে গতকাল সকালে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এ সময় বক্তৃতা করেন জেলা সুজনের সভাপতি আকবর হোসেন ও মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু।